দুর্ধর্ষ মঙ্গোল বীর চেঙ্গিস খান তখন পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্য জয় করে কেবল মঙ্গোলিয়ায় থিতু হয়েছেন। এবার তিনি চোখ ফেরালেন মধ্য এশিয়ার দিকে। তার ইচ্ছা- তিনি মধ্য এশিয়ার আরাে কিছু রাজ্য জয় করে গড়ে তুলবেন তার মঙ্গোল সাশ্রাজ্য। এ কারণে তিনি এই অঞ্চলের বাদশাহ ও গভর্নরদের কাছে দৃত প্রেরণ শুরু করেন।
মধ্য এশিয়ার খারেজমে নিযুক্ত খলিফা আলাউদ্দিনের গভর্নরের
কাছেও চেঙ্গিস খান তার দূত পাঠালেন। কিন্ত খলিফার নিযুক্ত সেই
গভর্নর আত্মভিমানের দরুন চেঙ্গিস খানের সেই দূতকে বিধিবদ্ধ সম্মান
তাে দেখালেনই না বরং তার সঙ্গে অত্যন্ত রূঢ় আচরণ করলেন। দূত
গভর্নরের দরবারে এলে তার সমস্ত মাল-সামানা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে
বন্দী করে রাখা হলাে এবং তাকে নানাভাবে নির্যাতন করা হলাে।
চেঙ্গিস খান যখন এ সংবাদ জ্ঞাত হলেন, তখন তিনি খলিফা
আলাউদ্দিনের নিকট একজন দূত পাঠিয়ে তার গভর্নরের অন্যায় আচরণ
সম্পর্কে অভিযােগ জানিয়ে তার ক্ষতিপূরণ দাবি করলেন।
কিন্তু এই মূর্খ খলিফা ছিলেন আরাে একধাপ বেতমিজ। খলিফা
চেঙ্গিস খানের পক্ষ থেকে আগত প্রতিনিধিদলকে বন্দী করে তাদের
নির্মমভাবে হত্যা করে ফেললেন। শুধু একজনকে বাঁচিয়ে রেখে তার
দাড়ি, গোঁফ ও ভ্রর অর্ধেক কামিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।
চেঙ্গিস খান তখন রাশিয়ার একটি অঞ্চলে শিকারে ব্যস্ত ছিলেন।
প্রতিনিধিদলের একমাত্র জীবিত লােকটি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়ে সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিলাে। চেঙ্গিস খান সবকিছু শুনে রাগে-ক্ষোভে
এক টিলার ওপর আরােহণ করে চিতকার করে বলতে লাগলেন, হে
মুসলমানদের খােদা! আমার ওপর জুলুম করা হয়েছে। সেই জালেমের
বিপক্ষে তুমি আমাকে সাহায্য করাে।
এরপর চেঙ্গিস খান ইরান আক্রমণের জন্য অগ্রসর হলেন।
যখন
তার বাহিনী মুসলিম সৈন্যদের মুখােমুখি হলাে, এক আল্লাহওয়ালা লােক
তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য বের হয়ে এলেন। কিন্তু তিনি অবাক
হয়ে লক্ষ করলেন, আল্লাহর ফেরেশতারা তাতারিবাহিনীর পেছনে
দাঁড়িয়ে বলছেন, 'ওহে কাফেরবাহিনী! ওই জালেমদের ওপর আক্রমণ
করে তাদের হত্যা করে ফেলাে।
ফলে সেদিন চেঙ্গিস খান এক মৃত্যুদূত হয়ে বিশ লক্ষাধিক লােক-
অধ্যুষিত শহর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন এবং আগুন জ্বালিয়ে সব
পুড়িয়ে ছাই করে দিলেন।
আফগানিস্তানের বামিয়ান নগরের এক লড়াইয়ে চেঙ্গিস খানের
পৌত্র নিহত হয়। এ ঘটনায় চেঙ্গিস খান এতােটা রােষায়িত হন, সে
নগর বিজয়ের পর এই মর্মে নির্দেশ জারি করা হলাে, নগরের একটি
কুকুর-বিড়ালও যেন জীবিত না থাকে। সব হত্যা করা হােক। ফলে সেই
হত্যাযজ্ঞ থেকে কোনাে মানবসন্তানের পক্ষেই রক্ষা পাওয়া সম্ভব হলাে
না। অথচ ইতােপূর্বে বিজিত সমস্ত নগরে যুবক-যুবতীদের দাস-দাসী
বানিয়ে শুধু বৃদ্ধ ও বয়স্কদেরকেই হত্যা করা হতাে।
আর ধন-সম্পদ সব
লুট করে নেওয়া হতাে। কিন্তু বামিয়ান নগরে এমনভাবে রক্তের বন্যা
বইয়ে দেওয়া হলাে, সেই বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞ অবলােকন করার জন্য
সেখানে একটি প্রাণীও জীবিত রইলাে না।
চেঙ্গিস খানের সর্বশেষ যুদ্ধ হয়েছিলাে সিদ্ধু নদের তীরে খারেজমের
শাহজাদা জালালুদ্দিনের সঙ্গে। সে যুদ্ধেও মুসলমানদের চরম পরাজয়
ঘটে।
ফলে তাতারিদের সম্পর্কে মুসলমানদের মনে এমন একটা আতঙ্ক
ছড়িয়ে পড়ে- তাতারিরা কখনাে পরাজিত হতে পারে না।
মােট কথা, মুসলমানগণ তাতারি দূতদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ
করার ফলে আল্লাহ তাআলা তাদের মুসলমানদের ওপর এমন প্রবল-প্রচণ্ড করে দিলেন, তারা মুসলমানদের সালতানাতকে ধ্বংসস্তুপে
করে পুরাে মুসলিম সালতানাতকেই ধূলিসাৎ করে ফেলেছিলাে। মঙ্গোল
তাতারিরা ত্রয়ােদশ শতকে মুসলিম দেশগুলােতে যে ধ্বংসযজ্ঞ
চালিয়েছিলাে, তার ক্ষতি আদৌ পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
পরিণত
ইসলামের রােশনিতে তাতারিরা
দম্ভের সাজা ভােগ করতে করতে মুসলমানদের অস্তিত্বের পিঠ যখন
একেবারে দেয়ালে গিয়ে ঠেকলাে, আল্লাহ তাআলা তখন দাওয়াত ও
তাবলিগি শক্তির প্রকাশ ঘটালেন।
চেঙ্গিস খান ততােদিনে মৃত্যুবরণ করেছেন। তার পুত্ররা ক্ষমতায়।
রাশিয়ার রাজত্ব চেঙ্গিস-দৌহিত্র জুজির হাতে। গােবি মরুতে অবস্থিত
কারাকোরামের শাসনভার আফদায়িনের হাতে।
তৃতীয় পুত্র চুগতাইকে
দেওয়া হয়েছিলাে তুর্কিস্তানের রাজ্যভার। আর চতুর্থ পুত্র তলওয়ায়িকে
দেওয়া হয়েছিলাে ইরাক-ইরান-আফগানিস্তানসহ অত্র
অঞ্চলের
শাসনভার।
চেঙ্গিস খানের অনেক পরের কথা। তখন চলছিলাে তার পৌত্র
হালাকু খানের যুগ। একমাত্র মিসর ছাড়া গােটা মুসলিম সাম্রাজ্য তখন
তাদের পদানত। হালাকু খান মিসর বিজয়ের মানসে যুদ্ধযাত্রার মনস্থ
করলেন। এ সংবাদে মুসলমানরা একেবারে হতাশ হয়ে পড়লাে।
তাদের
মধ্যে প্রতিরােধ বা প্রতি-আক্রমণের কোনাে মনােবলই রইলাে না।
মুসলমানদের এই ক্রান্তিকালে আল্লাহ তাআলার ভিন্ন এক নিদর্শন
কার্যকর হলাে। মিসরের তৎকালীন বাদশাহ রুকনুদ্দিন কিছুসংখ্যক
আলেম-ওলামাকে ব্যবসায়ীর সাজে তাতারিদের এলাকায় দাওয়াত ও
তাবলিগের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন।
তার উদ্দেশ্য ছিলাে- অস্ত্রবলে
তাতারিদের অগ্রযাত্রা প্রতিরােধ করা মুসলমানদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে
পড়েছে, তাই দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে তাদের মাঝে ইসলামের
আলাে ছড়িয়ে দিয়ে যদি কোনােভাবে মুসলমানদের চূড়ান্ত পতন রােধ
করা যায়!চেঙ্গিস খানের বড় পুত্র জুজির পৌত্র দরকা (বেরকি) খান ছিলেন
তৎকালীন রাশিয়ার অধিপতি। রাশিয়ায় তুর্কি মুসলিম ব্যবসায়ীগণ পণ্য
বিক্রির পাশাপাশি দীনের দাওয়াতের কাজও চালিয়ে যাচ্ছিলেন অক্লান্ত
ভাবে। ফলে তাতারিরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলাে।
সৌভাগ্যক্রমে নও-মুসলিমদের সে দলে দরকা খানের এক প্রভাবশালী
মন্ত্রীও ছিলেন। তিনি কৌশলে রাজার কাছে ইসলামের সৌন্দর্য পেশ
করতে লাগলেন। একদিন দরকা খান জিজ্ঞেস করলেন, 'তােমার কাছে
এসব কথা কারা বলে যায়?
মন্ত্রী বললেন, তুর্কিস্তানের সেই মুসলিম বণিকরা আমাদের এসব
কথা শুনিয়েছেন।
দরকা খান বললাে, তারা আবার এলে আমাকে জানাবে।
একসময় মুসলিম ব্যবসায়ীরা পুনরায় রাশিয়ায় আগমন করলে
তাদের রাজদরবারে উপস্থিত করা হলাে।
রাজা ইসলাম সম্পর্কে জানতে
চাইলেন। মুসলমানগণ তাকে কোরআনের মহাসত্যের কথা শােনালেন।
আল্লাহ তায়ালা তাকে হেদায়েত দান করলেন। ফলে তিনি ইসলামের
সৌভাগ্য-ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে ধন্য হলেন। রাজার ইসলাম গ্রহণ
করার ফলে তার প্রায় গােটা রাজ্যের অধিবাসীরাই ইসলাম গ্রহণ করে
নিলাে।
ওদিকে হালাকু খান মিসর আক্রমণ. করার সংকল্প করে সৈন্যসহ
বেরিয়ে পড়েছেন।
তিনি মিসর অধিপতি রুকনুদ্দিনের নিকট এই মর্মে
পয়গাম পাঠালেন- 'দেয়াল ভেঙে দাও, দরজা খুলে দাও। একই
জমিনের ওপর দুই ব্যক্তির শাসন চলতে পারে না। আমার কথা মেনে
নিলে তােমাদের প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া হবে। অন্যথায় নীলনদ তােমাদের
রক্তে রঞ্জিত হয়ে যাবে।
হালাকু খান তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করলেন। রুকনুদ্দিন সে
কথা জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে দরকা খানের নিকট পত্র লিখলেন।
দরকা
খান সে বিষয়ে অবগত হয়ে অনতিবিলম্বে হালাকু খানের নিকট এই মর্মে
পয়গাম প্রেরণ করলেন- 'মিসর আক্রমণের পূর্বে তােমাকে আমার
মােকাবেলা করতে হবে।
এই বার্তা পেয়ে হালাকু খান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'তােমার
মােকাবেলা কেন? তােমার কি চেঙ্গিস খানের সেই নীতি জানা নেই-
তাতারিরা পরস্পর কখনাে লড়াই করবে না?
জবাবে দরকা খান বললেন, 'তুমি একজন কাফের, আর সে-ও
ছিলাে একজন কাফের। কিন্তু আমি একজন মুসলমান।
আজ তােমার
আর আমার মাঝে কোনাে আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। এখন মিসর
আক্রমণ করতে চাইলে তােমাকে প্রথমে আমার মােকাবেলা করতে
হবে।
দরকা খানের এ পয়গাম পেয়েও হালাকু খান যখন তার সঙ্কল্পে
অটল রইলেন, তখন দরকা খানও তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে বেরিয়ে
পড়লেন এবং পঞ্চাশ বছরের তাতারি ইতিহাসে এই প্রথম দুই তাতারির
তলােয়ার পরস্পরের বিরুদ্ধে ঝনঝনিয়ে উঠলাে। আর ইতিহাস বদলের
এই বৈপ্লবিক ঘটনার পেছনে ভূমিকা ছিলাে কিছুসংখ্যক মুবাল্লিগে
দীনের।
এক মহান বিপ্লবের সূচনা
তাতারি জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন এবং এক ঐতিহাসিক বিজয় সূচিত হলাে। ঢাল নেই, তলােয়ার নেই, রাজ্য নেই, রাজত্ব নেই; শূন্য
হাতে এই বিপ্লব কীভাবে সম্ভব হলাে? আসলে বিপ্লব ঘটে মানুষের
হৃদয়ে। মানুষের মনােভাবের পরিবর্তনই মূলত তার মধ্যে বিপ্লব ঘটায়।
দাওয়াতের সেই নবিওয়ালা আমলই তাতারিদের কঠিন হৃদয়ের কপাট
ভেঙে তাতে এক মহাবিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলাে।
মানুষের হৃদয়জগতে যখন বিপ্লব ঘটে, সেখানে পরিবর্তন সৃচিত
হয়, তখন মানুষের মন আল্লাহমুখী হয়ে ওঠে এবং স্বতঃস্কূর্তভাবে তার
জীবনধারায় পরিবর্তন আসতে থাকে। মানুষের মাঝে যখন দাওয়াত ও
তাবলিগের কাজ চলতে থাকে, তখন আল্লাহ তাআলা মানুষের মনের
জমিনকে কোমল করে দেন। সেখানে বিপ্লবের বীজ রােপিত হয় এবং
তার মন ও মননে ক্রমশ আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
আর এভাবেই
কোনাে বাহ্যিক শক্তির সমর্থন ছাড়া আল্লাহ তাআলা এক তাতারিকে
আরেক তাতারির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে বাধ্য করেছিলেন।
মঙ্গোলবীর তৈমুরের ইসলাম গ্রহণ
তৈমুর তুঘলক ছিলেন হালাকু খানের তৃতীয় অধস্তন পুরুষ।
তদানীন্তন বুজুর্গ জালালুদ্দিন রহমাতুল্লাহি আলায়হি একবার তাকে দীনের
দাওয়াত দিলেন। জবাবে তিনি বললেন, 'এখনাে আমি একজন গভর্নর
মাত্র। যেদিন গােটা রাজ্যভার আমার হাতে আসবে সেদিন আসবেন,
আমি ভেবে দেখবাে।
কিন্তু জালালুদ্দিন (রহমাতুল্লাহি আলায়হি]-এর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত
তিনি বাদশাহ হতে না পারায় বুজুর্গ জালালুদ্দিন স্বীয় পুত্র রশিদুদ্দিনকে
ওসিয়ত করে যান- 'প্রিয় পুত্র!
আমি তাে দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছি।
তৈমুর তুঘলক যখন বাদশাহ হবে, তখন তুমি আমার পয়গাম তার নিকট
পৌছে দিও।
তৈমুর বাদশাহ হওয়ার পর রশিদুদ্দিন রহমােতুল্লাহি আলায়হি তার
রাজধানী মঙ্গোলিয়ার উদ্দেশে রওনা হলেন। কিন্তু সেই রাজমহলে
পৌছার কোনাে উপায় তিনি খুঁজে পেলেন না। প্রহরীরা তার মতাে
অপরিচিত কাউকে প্রাসাদে ঢােকার অনুমতি দিলাে না।
কোনাে উপায় না পেয়ে এক রাতে তিনি প্রাসাদের কাছে দাঁড়িয়ে
খুব জোরে ফজরের আজান দিলেন।
আজান শুনে রাজার ঘুম ভেঙে
গেলাে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'এটা কমন সঙ্গীত? এমন জোরে কে
চিতকার করছে? তাকে ধরে নিয়ে আসাে।
এরপর তাকে রাজদরবারে উপস্থিত করা হলাে। রাজা জিজ্ঞেস
করলেন, 'দরবেশ! আপনার পরিচয় কী?
তিনি বললেন, আমি জালালুদ্দিনের পুত্র রশিদুদ্দিন।
তৈমুর আবার জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনার এখানে আগমনের
উদ্দেশ্য কী?
রশিদুদ্দিন বললেন, "আপনি আমার পিতাকে বলেছিলেন, 'যখন
আমি বাদশাহ হবাে, তখন এসাে। আমি তার সেই দায়িত্ব পালন করতে
এসেছি।"
তৈমুর তুঘলক বললেন, 'হ্যা, এবার ইসলাম সম্পর্কে আমাকে
বলাে।
তিনি দাওয়াত দিলেন। ফলে তৈমুর ইসলাম গ্রহণ করলেন।
ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি তার এক উজিরকে ডাকলেন। তাকে
বললেন, 'আমি তাে ইসলাম গ্রহণ করেছি, তুমি কী বলাে?
উজির ছিলেন চারজন। তাদের একজন মুসলমান হয়ে গিয়েছেন।
বাকি তিনজনকে ডেকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হলাে। ফলে তারাও
ইসলাম গ্রহণ করে নিলেন। তারপর ডাকলেন সেনাপতিকে। তাকে
বললেন, 'আমি তাে ইসলাম গ্রহণ করেছি, তােমার কী অভিমত?
সেনাপতি বললেন, মুখের ভাষার চেয়ে তলােয়ারের ভাষাই আমার
কাছে অধিক বােধগম্য। অস্ত্রের ভাষাই আমি বেশি বুঝি। আপনাকে যে
ব্যক্তি ইসলামের দাওয়াত দিতে এসেছে, তাকে আমার সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে
অবতীর্ণ হতে হবে। সে যদি আমাকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়,
কেবল আমি ইসলাম গ্রহণ করবাে, অন্যথায় নয়।
তবেই
তৈমুর বললেন, 'এটা কীভাবে হতে পারে। যে বিষয়কে জ্ঞান দিয়ে
উপলব্ধি করতে হয়, তা তুমি অস্ত্র দিয়ে বুঝতে চাইছাে?
সেনাপতি বললেন, 'আপনি যা-ই বলুন, কোনাে কিছু উপলব্ধি
করার জন্য আমার কাছে এই অস্ত্র ছাড়া ভিন্ন কোনাে পথ নেই।
রশিদুদ্দিন রহমাতুল্লাহি আলায়হি তখন বললেন, 'ঠিক আছে, আমি
তার সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবাে।
তাকে বলা হলাে, 'এটা ঠিক হবে না। কারণ, এই সেনাপতি তার
গােটা জীবন যুদ্ধ আর অস্ত্র নিয়ে কাটিয়েছে।
তার সঙ্গে লড়াই করতে
যাওয়া আত্মহত্যারই নামান্তর। সবকিছু জেনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা
অবশ্য আপনার তিনি বললেন, 'আমি লড়াই করবাে।
পরদিন লড়াই হবে বলে শহরে ঘােষণা দিয়ে দেওয়া হলাে।
রশিদুদ্দিন রহমাতুল্লাহি আলায়হি রাতে আল্লাহ তায়ালার নিকট হাত তুলে
দোয়া করলেন, 'হে আল্লাহ! আপনার দীনের দাওয়াত দিতে এসেছি।
এখন যদি আমাকে মারতে হয়, মেরে ফেলুন।
আর যদি দীনের কাজ
করাতে হয় তাে আপনিই সে ব্যবস্থা করুন।
পরদিন নির্দিষ্ট স্থানে গােটা নগর ভেঙে পড়লাে। সেনাপতি দুটি
লৌহবর্ম পরিধান করে ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। তার দুই হাতে দুটি
তরবারি।
ওদিকে তার প্রতিপক্ষ রশিদুদ্দিন রহমাতুল্লাহি আলায়হির হাতে
একটি ক্ষুদ্র খঞ্জরও নেই। একেবারে শূন্য হাতে ময়দানে এসে উপস্থিত
হলেন। তখন সেনাপতি তাকে নিজের একটি তরবারি দিয়ে বললেন,
'এই নাও অস্ত্র।
রশিদুদ্দিন রহমাতুল্লাহি আলায়হি বা হাতে সেই তরবারি তুলে নিয়ে
ডান হাতে সেনাপতির বুকে এমন এক ঘুষি মারলেন, তিনি দূরে ছিটকে
পড়ে বেইুশ হয়ে গেলেন।
জ্ঞান ফিরে আসার পর সেনাপতি বলতে লাগলেন, এক ঘুষিতেই
আমি ইসলাম বুঝে গিয়েছি। লড়াইয়ের আর প্রয়ােজন নেই।
এরপর বাদশাহ তৈমুরের হাতে সে দেশের দশ লাখ লােক ইসলাম
গ্রহণ করলেন।
মঙ্গোলিয়ায় বাদশাহ তৈমুরের সমাধি এখনাে বিদ্যমান আছে।
সে
সমাধির গায়ে লেখা আছে- 'তাতার অধিপতির সমাধি, যার হাতে দশ
লক্ষ লােক ইসলাম গ্রহণ করেছিলাে।
দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতকারী মুষ্টিমেয় কিছু লােক সেদিন
উম্মতের ওপর বিশাল ইহসান করে গিয়েছেন। তাতারিরা যদি তখন
ইসলাম গ্রহণ না করতাে, তাহলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের অগ্রযাত্রা
রুখার মতাে কোনাে শক্তি ছিলাে না।
সে জাতি এমনই শক্তিশালী ছিলাে,
ক্ৰমাগত তিন দিন পর্যন্ত না খেয়ে তারা ঘােড়ার পিঠে ছুটে বেড়াতে
পারতাে। খুব পিপাসাকাতর হয়ে পড়লে ঘােড়ার পিঠে খণঞ্জর মেরে নির্গত
রক্তের ধারা পান করে নিতাে। এই ছিলাে তাদের পানীয়।
i
এমন একটি জাতির মােকাবেলা বাহুবলে করা খুব কঠিন বৈকি।
সেই দুর্জয় জাতিকে দাওয়াত ও তাবলিগের বরকতে আল্লাহতায়ালা
মুসলমান বানিয়ে দিলেন। রাশিয়ার সে অঞ্চলের অধিবাসীরা এখনাে
পর্যন্ত ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রিত আছে।