ভিনদেশি - Vindesi Bangla Golpo Part 1

ভিনদেশি - Vindesi Bangla Golpo Part 1


গ্রামের নাম সানিয়্যা, এ বসতির একটা নাম আছে- সানিয়্যা। বসরা থেকে শ' পাচেক মাইল দূরের এক জনবসতি। বসরার এ অঞ্চলের পুরােটাই প্রায় মরুময় হলেও সানিয়্যা এলাকাটি বেশ সবুজ শ্যামলে ছাওয়া। খেজুর বাগান তাে বটেই, বসতির চাষিরা মৌসুমে আঙুর, যব আর গমের আবাদও করে পাশের জমিগুলােতে। 

এছাড়া জয়তুন গাছ প্রায় ছেয়ে আছে পুরােটা এলাকায়। আছে হরেক রকম ফুলের বাগানও। বসরার গােলাপ বলে বিখ্যাত যে প্রবাদ, সে গােলাপের চাষ এখানে না হলেও নার্গিস, অর্কিড, বাগানবিলাস, বিভিন্ন রঙের ঘাসফুলে মাতােয়ারা পুরাে সানিয়্যা। বসতির দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে চলেছে একটি শান্তশিষ্ট পাহাড়ি নদী। 

পাহাড়ি নদী বলে এর জল স্কটিকের মতাে স্বচ্ছ আর স্বাদু। কুলকুল শব্দে বয়ে চলা ঝরনানদীর শ্রোতের দিকে তাকালে নিচের পাখুরে জমিন স্পষ্ট নজরে আসে, যেন স্বচ্ছ কাচের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে সলীলা শ্রোত। বসতির পাশে না হলেও পাহাড় খুব একটা দূরে নয় সানিয়্যা থেকে। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে তাকালে সহজেই চোখে পড়ে পাহাড়শ্রেণি। 

গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একেকটা পাহাড়। পাহাড়ের এ গান্ভীর্যতার কারণেই এলাকাবাসীও কেন যেন দারুণ ভয় পায় দূরের পাহাড়গুলােকে। বসতিবাসী বড় একটা যায় না পাহাড়ের দিকে। বসতিবাসীর ভয় পাওয়ার বড় একটা কারণ অবশ্য আছে। ওই পাহাড়ের ওপারেই রােম সাম্রাজ্য। রােমীয় বাহিনীর বড় একটি ফৌজি ঘাঁটিও আছে পাহাড়ের ওপাশে। 

কখন না কখন তারা হামলা করে বসে, সেই ভয় তাদের মনের মধ্যে সব সময়ই বাসা বেঁধে থাকে। কেননা ইরাকের অন্যান্য শহর ও বসতির মতাে সানিয়্যাও পারস্য সম্রাটের অধীন। এ কারণে রােম-পারস্য যুদ্ধ জড়িয়ে পড়লে তার ঢেউ যে এখানে লাগবে না- এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। সানিয়্যা এমনিতে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ কোনাে এলাকা না হলেও এর সৌন্দর্যের খ্যাতি ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। 

ইরাকের বিভিন্ন শহরের বিত্তবান লােকজন আমােদ-প্রমােদের জন্য বছরে দু-একবার এখানে চলে আসেন। বিশেষত বছরের এ সময়টা অবকাশ যাপনের জন্য সবচেয়ে আরামদায়ক। মৌসুম শুরু হতে হতে ইতােমধ্যেই কিছু পরিবার চলে এসেছে। তাদের মধ্যে বসরার কাছে উবুল্লা নামের একটি সমৃদ্ধ গভর্নর সিনান নুমাইরির পরিবারও রয়েছে। 

নগরীর সিনান নুমাইরি প্রশাসনিক ঝামেলা সামলাতে সামলাতে অবকাশযাপনে আসতে পারেননি পরিবারের সঙ্গে। রােমের সম্রাটের সঙ্গে এ মুহূর্তে পারস্য সম্ত্রাটের বনিবনা হচ্ছে না মােটেই। দুই দেশের রাজধানী থেকেই নানা কথা শােনা যাচ্ছে। যেকোনাে মুহূর্তে একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। 

এ কারণে স্ত্রী সালমা বিনতে কায়িদ আর পাঁচ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে সুহাইবকে প্রয়ােজনীয় লােক-লশকরসহ পাঠিয়ে দিয়েছেন সানিয়্যায়। কথা দিয়েছেন- প্রশাসনিক ঝামেলা সামলে তিনি দু-তিন দিন পরই চলে আসবেন। বাদবাকি খােদার মর্জি! বিদায়, মা রাতে সানিয়্যা পল্লির ওপর অতর্কিত হামলা হলাে। 

রােমীয় সৈন্যরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে প্রথমেই আগুন ধরিয়ে দেয় বসতির ঘর আর আস্তাবলগুলােতে। তারপর চালাতে থাকে লুটতরাজ। সামনে যাকে পেলাে তাকেই হত্যা করলাে। বসতির বিশ- পঁচিশ জন প্রহরী যারা ছিলাে তাদের অনেকেই দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করলাে। 

বাদবাকি কয়েকজন প্রতিরােধের চেষ্টা বৃথা দেখে হাতিয়ার ফেলে আত্মসমর্পণ করলাে। প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ধন-সম্পদ যা পেলাে সব লুটে নিলাে রােমীয়রা। পুরুষরা অধিকাংশই নিহত হয়েছে, নয়তাে পালিয়ে গেছে। নারী ও শিশু যাদের পেলাে, তাদের বন্দী করা হলাে। 

বসতিতে হামলা শুরু হতেই সালমা বিনতে কায়িদ ছেলে সুহাইবকে বুকে আগলে নিয়ে ঘরের এক কোণে লুকিয়ে ছিলেন। রােমানরা ঘরে সতেই শিশু সুহাইব ভয় পেয়ে চিতকার করে কেঁদে ওঠে। রােমানরা তাদের দেখতে পেয়ে দুর্জনকেই ধরে নিয়ে গেলাে। রােমানরা নারী ও শিশুদের ওপর হামলা না করলেও তাদের সঙ্গে বড় একটা ভালাে ব্যবহার করতাে না। 

নারী ও শিশুদের বন্দী করে তারা তাদের বিক্রি করে দিতাে দাসবাজারে। দিনের আলাে ফোটার আগেই রােমানরা সানিয়্যা থেকে বন্দী করে নিয়ে আসা নারী ও শিশুদের দুটো আলাদা দলে ভাগ করে রােমের দিকে নিয়ে যেতে লাগলাে। এক দলে নারী, অপর দলে কমবয়সী শিশুরা। বন্দী হওয়া নারীদের দলটিতে ছিলেন সালমা। তিনি রােমান সৈন্যদের হাতে-পায়ে ধরে বলতে লাগলেন, ওই শিশুদের দলে আমার পাঁচ বছর বয়সী ছেলে আছে। আমাকে না পেয়ে সে দিশেহারা হয়ে কঁদছে। দয়া করে তাকে আমার কাছে এনে দাও, নয়তাে 

একটিবারের জন্য আমাকে যেতে দাও তার কাছে। তার কথায় রােমান সৈন্যদের দিল মােটেও নরম হলাে না। পারসিকদের তারা পশুর চেয়েও ঘৃণা করে। তাদের ব্যাপারে তাদের অন্ত রে কোনাে দয়ামায়া নেই। যুগ যুগ ধরে রােম আর পারস্য সাম্রাজ্যের মাঝে জারি রয়েছে যে জাতিগত লড়াই, এ ঘৃণা সে লড়াইয়েরই বিষফল। দুটো জাতির মাঝে তুলে রেখেছে শুধু ঘৃণা আর শত্ৰুতার দেয়াল। 

এর বাইরে আর কিছু ভাববার অবকাশ নেই তাদের। রােমান ফৌজি চৌকিতে নিয়ে আসা হলাে পারস্যের বন্দীদের। বন্দীদের সবার হাতে-পায়ে শেকল বা দড়ি বাঁধা। এখানে এনে তাদের পেশ করা হলাে উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার সামনে। এতােগুলাে নারী ও শিশু দেখে তার চোখ লােভে চকচক করে উঠলাে। 

বাজারে বিক্রি করে দিলে পাওয়া যাবে অনেক নগদ আশরফি। সিপাহিদের তখনই হুকুম দিলেন নারীদের দলটিকে মার্ভের বাজারে নিয়ে যেতে, আর শিশুদের দলটিকে মাদায়েনের বাজারে নিয়ে যেতে। কেননা বাজারভেদে দাসের বাজার একেক রকম। সেটা বুঝেই তিনি দুই দলকে দুটো আলাদা বাজারে নিয়ে যেতে বললেন। 

সালমা দেখলেন, তার ছেলেকে নিয়ে একটা ঘােড়ার গাড়িতে চড়ানাে হলাে। তার সঙ্গে আরাে অনেক শিশু। তিনি চিৎকার করে ছেলের নাম ধরে ডাকলেন। ছেলে সুহাইব মায়ের ডাকে চোখ তুলে তাকালাে। দেখলাে, তার মাকে একটা থামের সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে ছেলেকে ডাকছেন। সুহাইবও মাকে দেখে মা... মা... বলে চিতকার করে উঠলাে। 

এতে রােমান সৈন্যদের মনে কোনাে ভাবান্তর হলাে না। তারা বরং বিরক্তই হলাে। যারা শিশুদের নিয়ে গাড়িতে তুলছিলাে, তারা সবাইকে উঠিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিলাে। শিশু সুহাইব চিতকার করছিলাে দেখে ঠাস করে তার গালে একটা চড় মেরে গাড়ির মেঝেতে ফেলে দেয়া হলাে। 

অন্য শিশুদেরও চিতকার করতে নিষেধ করে কোচোয়ান গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেলাে। ছেলেকে চলে যেতে দেখে সালমা পাগলিনীর মতাে বুক চাপড়াতে লাগলেন। সর্বসাধ্য দিয়ে লােহার শেকল ছিড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন। লােহার শেকল ছিড়লাে না, বরং হাতের কবজিতে শেকলের কবজাগুলাে বসে গেলাে। চামড়া ফেটে রক্ত গড়াতে লাগলাে। সেদিকে তার ভ্রক্ষেপ নেই। নিজেকে মুক্ত করতে তিনি দাঁত দিয়ে কামড়াতে লাগলেন লােহার শেকল। 

কিছুতেই কিছু হলাে না। তাকিয়ে দেখলেন, ছেলেকে নিয়ে যাওয়া গাড়িটি দূর খেকে দূরে চলে যাচ্ছে। একটু পরই চোখের আড়াল হয়ে যাবে। তার মনে হলাে, এ জীবনে আর কোনাে দিন তিনি ছেলের দেখা পাবেন না। ছেলের মুখটা দু'হাতে তুলে আর কোনাে দিন আদর করতে পারবেন না। সালমা অক্ষম আক্রোশে গগনবিদারী চিত্কার দিয়ে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুললেন। হঠাৎ তার পিঠে স্যাৎ করে চাবুকের বাড়ি পড়লাে। কয়েকটা বাড়ি পড়তেই পিঠ দিয়ে দরদর করে রক্ত গড়াতে লাগলাে। 

একটু পরই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন সালমা। তার নিরজীব দেহটা পড়ে রইলাে রক্ত আর ধুলােয় গড়াগড়ি করে। কালকের গভর্নরের প্রিয়তম স্ত্রী আজ ক্রীতদাসী হিসেবে শেকলবন্দী হয়ে পড়ে আছেন মাঠের ধুলােয়। কালকের মমতাময়ী মা আজ রক্তাক্ত দেহ নিয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় দিলেন নিজের নাড়িছেড়া সন্তানকে। মা ও ছেলের দেখা হয়নি এ জীবনে কোনােদিন আর। ভবিষ্যদ্বাণী সুহাইব ইবনে সিনান। বসরার সুহাইব। বছর পাচেকের সুহাইব। বিক্রি হয়ে গেলেন মাদায়েনের দাসবাজারে। তার মুনিব তাকে নিয়ে গেলাে সিরিন। 

আবার বিক্রি হলেন। নতুন মুনিব নিয়ে গেলাে হিরায়। কিছুদিন পর বিক্রি হলেন আরেক মুনিবের কাছে। তিনি তাকে নিয়ে গেলেন নিজ শহর মার্ভে। সেখান থেকে আরেক মুনিব, তারপর আরেকজন। সুহাইব রােমের শহরে শহরে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন দাস হিসেবে। শৈশব পেরিয়ে কৈশাের, কৈশাের থেকে তারুণ্য, তারুণ্য থেকে হয়ে উঠলেন পরিপূর্ণ যুবক। ভুলে গেলেন মাতৃভাষা আরবি। ভুলে গেলেন আরবের সংস্কৃতি। ভুলে গলেন মাতৃভূমির পথ। ভুলে গেলেন সেই বসরা। সেই আঙুর বাগানের শৈশব। শুধু মনে রইলাে মায়ের মুখটা। চিৎকার করতে থাকা বেদনায় লীন হওয়া মায়ের মুখচ্ছবি।
Previous Post Next Post