পিতার আদর। ভালােবাসার ছােট্ট একটা গৃহকোণ। আর মনে রইলাে একদা তিনি আরব ছিলেন। সুহাইব ইবনে সিনান এখন রােমের রাজধানীতে। বয়সে পরিপূর্ণ যুবক। কাজ করেন এক আমিরের বাড়িতে। ক্রীতদাস হিসেবে প্রায় পনেরাে বছর কাটিয়ে দিয়েছেন রােমের বিভিন্ন শহরে।
নিজের অতীত খুব একটা মনে পড়ে না এখন তার। বসরার
স্মৃতিগুলাে ঝাপসা হয়ে গেছে মন থেকে। তবে মনের মধ্যে সব সময়
বাজে- আমি আরব। আমাকে একদিন আরবে ফিরে যেতে হবে।
আরবদের মতাে হতে তিনি যে মুনিবের বাড়িতেই থেকেছেন সেখানেই
কিছু-না-কিছু যুদ্ধবিদ্যা শিখে নিয়েছেন।
বিশেষ করে তিরন্দাজিতে তার
দক্ষতা ছিলাে প্রবাদতুল্য। আকাশে উড়ন্ত পাখিকে তিনি তিরের আঘাতে
নিমিষেই পেড়ে ফেলতে পারতেন।
সুহাইব ক্রীতদাস হিসেবে রােমে থাকলেও তার মনের মধ্যে সর্বদা
বিরাজ করতাে আরবের ভালােবাসা। রােমের বড় বড় শহর আর
চাকচিক্যের মাঝে জীবন কাটালেও তার মন পড়ে থাকতাে আরবের
মরুতে টাঙানাে তাঁবুর মধ্যে।
সেই খর্জুরবীথিকা, সেই বালুময় বসতি,
সেই দুরন্ত যাযাবর জীবন তার অবচেতন মনে গেঁথে থাকে। আরবের
দুর্লজ্ঘ আকর্ষণ তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেন না। শুধু
প্রতীক্ষা করেন- কবে তিনি পালাতে পারবেন পারস্যের এই লৌকিক
সভ্যতা থেকে। সুযােগের অপেক্ষায় থাকেন।
একদিন বাজার থেকে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে দেখলেন এক জায়গায়
কিছু মানুষের জটলা। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলেন। এক খৃস্টান কাহিন
(ভবিষ্যদ্বক্তা) দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে তার ধর্ম প্রচার করছিলাে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে খুস্টধর্ম রােমে বিধিবদ্ধ নয়। এ ধর্মের অনুসারী বা
প্রচারকদের পেলে সরকারি পেয়াদারা নানাভাবে হেনস্থা করে থাকে।
রােমানরা আগুন বা বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করে থাকে। এর বাইরে
অন্য কোনাে ধর্ম বরদাশত করতে তারা রাজি নয়। এ কারণে খৃস্টানরা
লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের ধর্ম প্রচার করে।
সুহাইবের খৃস্টধর্ম বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই। তার আসলে
কোনাে ধর্মের প্রতিই আকর্ষণ নেই। না রােমীয়দের আগুন পূজা, না
খৃস্টধর্মের অলীক আরাধনা। তিনি এসবের মাঝে কোনাে প্রাণ খুঁজে পান
না। আর তিনি নিজেও জানেন না ছােটবেলায় তার পিতা-মাতার ধর্ম কী
ছিলাে।
এ কারণে ধর্মপালনে তার তেমন বাধ্যবাধকতাও নেই। শুধু
রাতে একা থাকেন যখন, তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবেন- যে
এতাে লক্ষ-কোটি নক্ষত্র সৃজন করলাে, কে সে?
তিনি জটলায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন। এমন
সময় খৃস্টান কাহিন বলে উঠলাে- 'সে সময় প্রত্যাগত, যখন জাজিরাতুল
আরবের মক্কায় একজন নবি আসবেন। যিনি হবেন শেষ নবি। তিনি
ঈসা ইবনে মরিয়মের ধর্মকে সত্যায়িত করবেন এবং মানুষকে অন্ধকার
থেকে আলাের দিকে আহ্বান করবেন।
আরবের কথা শােনামাত্রই সুহাইব থমকে দাঁড়ালেন। আরবে
একজন নবি আসবেন?
শেষ নবি? তিনি মক্কায় আসবেন? সুহাইব
কাহিনকে আবার বলতে বললেন কথাটা। কাহিন আবার বললাে।
সুহাইবের হৎস্পন্দন বেড়ে গেলাে কথাটা আবার শােনার পর। অবশেষে
তাহলে আরবেই নবি আসবেন? আমার আরবে?
তবে কি আমার ডাক এসেছে আরব থেকে?
মক্কায়, নবির শহরে
সুহাইব ফিরে এলেন বাজার থেকে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে
ফেলেছেন যে করেই হােক তাকে পালাতে হবে।
এক রাতে সত্যি সত্যি পালালেন নিজের মুনিবের থেকে। রােমের
বিভিন্ন শহর পাড়ি দিয়ে চলে এলেন আরবে। কাহিনের ভবিষ্যদ্বাণী
অনুযায়ী পাড়ি জমালেন মক্কায়।
মক্কায় তিনি আগম্ভক। একদম অচেনা শহর, পথঘাট। এখানকার
মানুষজন কাউকেই চেনেন না।
কী করবেন, কোথায় থাকবেন তার
কোনাে বন্দোবস্ত নেই। অবশ্য সঙ্গে করে বেশ কিছু আশরফি নিয়ে
এসেছেন তিনি। এ পর্যন্ত রােমে যা আয় করেছিলেন, তার কিছুই খরচ
করেননি। সব সঞ্চয় করে রেখেছিলেন।
মক্কার এক লােকের সঙ্গে অবশেষে পরিচয় হলাে। তার নাম
আবদুল্লাহ ইবনে জুদআন।
লােকটা এমনিতে ব্যবসায়ী। আমানতদার ও
অতিথিপরায়ণ হিসেবে তার সুনাম আছে।
সুহাইবকে দেখে আবদুল্লাহ ইবনে জুদআন প্রথমে মনে করেছিলেন
তিনি পারস্য বা রােমের লােক। কেননা সুহাইবের মাথার চুল ছিলাে
লালচে এবং তার কথার মধ্যে কিছুটা জড়তা ছিলাে।
যার দরুন তাকে
আরব ভাবাটা ছিলাে কষ্টকর। তাছাড়া তিনি আরবি ভাষা পুরােটা না
হলেও অনেকটা ভুলে গিয়েছিলেন। ভাঙা ভাঙা আরবিতে কথা বলছিলেন।
অবশেষে সুহাইব যখন তার জীবনবৃত্তান্ত খুলে বললেন, তখন
আবদুল্লাহ তাকে অভয় দিলেন- 'এ মক্কায় তােমার কোনাে ভয় নেই।
তােমার যতােদিন ইচ্ছা তুমি আমার বাড়িতে থাকতে পারাে। আজ হতে
তুমি আমার ভাই।
এক দিন গেলাে, দুই দিন গেলাে, তৃতীয় দিন সুহাইব আবদুল্লাহ
ইবনে জুদআনকে জানালেন, তিনি ব্যবসা করতে আগ্রহী। তার আগ্রহ
দেখে আবদুল্লাহ ইবনে জুদআন খুশি হলেন।
নিজের ব্যবসার অংশীদার
করে নিলেন।
তায়েফ, দামেস্ক, জেরুসালেমে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করতেন
আবদুল্লাহ। নিজের ব্যবসার সঙ্গে এবার সুহাইবকেও অংশীদার করে
নেয়ায় অল্পদিনের মধ্যেই ব্যবসা বেশ চাভা হয়ে উঠলাে। বছর তিনেকের
মধ্যে তারা আরবের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেন।
সুহাইব নিজের ব্যবসায়ী সাফল্য নিয়ে বেশ তৃপ্ত। যাক,
স্বাধীনভাবে স্বাধীন ব্যবসা করে নিজের জীবনটা সাজিয়ে তােলা যাবে।
এবার কিন্তু এতাে সাফল্য, এতাে সম্পদ আহরণের পরও সুহাইবের মন থেকে
উৎকণ্ঠা কমেনি এক বিন্দুও- কবে আসবেন নবি? তিনি শত ব্যস্ততার
মাঝেও নবির জন্য প্রতীক্ষা করতেন। ব্যবসার কাজে দূরে কোথাও
গেলে, ফিরে এসেই খবর নিতেন মক্কার- নতুন কোনাে ঘটনা ঘটেছে কি
না।
আশপাশের বসতিগুলােতে খোজ করতেন, সেখানে কোনাে নতুন
কাহিনি সংঘটিত হয়েছে কি না।
এমনই এক সফর থেকে ফিরে এসেছেন মক্কায়। লম্বা সফর ছিলাে।
অনেক দিন ছিলেন মক্কার বাইরে। মক্কার খবরাখবর এ কয়দিন জানেন
না কিছুই। ফিরে এসেই বিভিন্নজনের কাছে জানতে চাইলেন মক্কার হাল-
হকিকত।
একজনের কাছে শুনতে পেলেন, মক্কার মুহাম্মদ নামের লােকটি
নিজেকে আল্লাহর নবি ঘােষণা করেছেন।
তিনি মানুষকে মূর্তিপূজা ছেড়ে
এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর উপাসনা করার আহ্বান জানাচ্ছেন। তিনি
অন্যায় ও অশ্লীলতা ছেড়ে মানুষকে সভ্যতার দিকে ডাকছেন। ন্যায় ও
ইনসাফের সমাজ গড়ার কথা বলছেন।
সুহাইব ইবনে সিনানের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলাে। তিনি জলদি
লােকটির কাছে জানতে চাইলেন, 'ইনি কি সেই লােক, যাকে তাঁর বিশ্বস্ত
তা আর সত্যবাদিতার জন্য আল-আমিন বলে ডাকা হয়?
লােকটি বললাে, 'হ্যা, ইনিই সেই ব্যক্তি।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'তাঁর বর্তমান অবস্থান কোথায়? এ মুহূর্তে
তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?
জানানাে হলাে, 'তিনি আপাতত সাফা পাহাড়ের পাশে আল-
আরকাম ইবনে আবিল আরকামের বাড়িতে অবস্থান করছেন।
তবে তুমি
যদি সেখানে যেতে চাও, সাবধানে যেও। কেননা কুরাইশরা তাঁর পেছনে
লেগে আছে। তারা কাউকে মুহাম্মদের কাছে যেতে দেখলে তার সঙ্গে
অত্যন্ত বাজে ব্যবহার করে। তুমি তাে ভিনদেশি, তােমার সঙ্গে যদি
তারা কোনাে অন্যায় আচরণ করে ফেলে, তবে তােমাকে বাঁচানাের মতাে কেউ নেই এখানে।
মক্কায় তােমার বংশ-গােত্রের লােকজনও কেউ নেই
যে তােমাকে তাদের হাত থেকে বাঁচাবে।
সুহাইব ইবনে সিনানের কান দিয়ে এখন আর কিছুই ঢুকছে না। না
লােকটির ভবিষ্যদ্বাণী, না তার সাবধানবাণী। তার মাথায় এখন শুধু
একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে- মক্কায় অবশেষে সেই কাঙিক্ষিত নবি
এসেছেন!
যিনি সত্যায়ন করবেন পূর্ববর্তী সত্য ধর্মের। যিনি মানুষকে
নিয়ে যাবেন অন্ধকার থেকে আলাের ঝরনাধারার দিকে। যিনি পরমাত্মার
সঙ্গে মানুষের অন্তরাত্মার সম্মিলন ঘটিয়ে দেবেন। তিনি এসেছেন
অবশেষে!
সুহাইব পাগলের মতাে হাঁটতে লাগলেন। তার কোনাে দিকে
খেয়াল নেই- কিসের কুরাইশ আর কিসের সাবধানবাণী! আজ তিনি
মহাসত্যের সামনে দাঁড়াবেন, তার আজ ভয় কিসের!
পৌছে গেলেন আল-আরকামের বাড়ির সামনে। থমকে দাঁড়ালেন
একটু। বাড়ির সামনে কেউ একজন দাড়ানাে আছে। কে? আম্মার?
আম্মার ইবনে ইয়াসির?
আম্মারকে আগে থেকেই চিনতেন তিনি। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস
করলেন, 'কে, আম্মার নাকি? তুমি এখানে?
আম্মার ইবনে ইয়াসির পাল্টা প্রশ্ন করলেন, 'আমার কথা ছাড়াে,
তুমি এখানে কী করছাে?
সুহাইব ইবনে সিনান সােজাসাপ্টা বললেন, 'আমি এ লােকের কিছু
কথা শুনতে চাই। তিনি কী কথা বলেন, সে ব্যাপারে একটু জানতে
ইচ্ছুক।
এবার আম্মার ইবনে ইয়াসির বললেন, 'আমিও একই পথের
পথিক।
সুহাইব বললেন, 'তাহলে আর দেরি কেন? চলাে, আল্লাহর নাম
নিয়ে ভেতরে যাই। তারা উভয়ে দারুল আরকামে প্রবেশ করলেন।